বিবাহিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে পারবে না, এমন কোনো আইন নেই। তাহলে মেধা অনুসারে হলে সিট বরাদ্দ না করে বিবাহিত না অবিবাহিত এ বিবেচনায় সিট বরাদ্দ কেন হবে? বিবাহিত ছাত্রীরা হলে বিশেষ বিবেচনায় সিট পাবে আর অন্তঃসত্ত্বা হলে সিট বাতিল হবে, এ ধরনের বৈষম্যমূলক আইন নিয়ে ছাত্রীরা আজ আলোচনায় মুখর। বিষয়টি নিয়ে সত্যিই ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। বিবাহিত হয়েছে বলে কি ঢাবির ছাত্রীরা হলে সিট পাবার অধিকার রাখে না? আসুন তবে, বাস্তবতার নিরিখে কিছু বিষয় দেখে আসি।
সম্প্রতি ঢাবির ছাত্রী ইলমা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমরা জেনেছি। নিজের পড়ালেখা বা ক্যারিয়ার নয়, ইলমা চিন্তিত ছিলো তার বিয়ে হবে কি হবে না, এই নিয়ে। এমন কি তার পরিবারও মূলত বিয়ে নিয়েই বেশি চিন্তিত ছিলো। পরে দ্রুতই তার বিয়ে হয়ে যায়। ইলমাও আনন্দিত ছিলো তার বিয়ে নিয়ে। কিন্তু এ বিয়ের পরের চিত্রটি কেমন ছিলো? ইলমার স্বামী কি তার পড়ালেখা নিয়ে কোনো ধরনের উৎসাহ দিয়েছে? না, ইলমাকে ক্লাস ও পরীক্ষাতে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয়নি। এরকম ক্ষেত্রে একজন বিবাহিত ছাত্রীর জন্য হল হতে পারে ভালো আবাসস্থল। হলে থাকলে সে তার পড়া ও ক্যারিয়ারে আরো ভালো করে মন দিতে পারবে। কিন্তু বিষয়টি বিবেচনা করলেও কিছু অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে। পুরুষরা বেছে বেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী মেয়েদের বিয়ে করবে, এরপর মেয়েগুলোর পড়া ও ক্যারিয়ারে বাধা সৃষ্টি করবে, কোন দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। ফলে সব দায়িত্ব পালনের ভার এসে পড়বে ঢাবি কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে এসে।
বিবাহিত ছাত্রীদের হলে সিট বরাদ্দ দেওয়ার অসুবিধাগুলোও তাই বিবেচনা করা দরকার। মেধানুসারে হয়তো বিবাহিত একজন ছাত্রী সিট পেয়ে গেলো। কিন্তু সে যদি ঠিকমতো ক্লাস, পরীক্ষা ও অন্যান্য একাডেমিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ না করে, তবে তা হবে শুধু শুধু একটি সিট দখল করে রাখা। অথচ এ সিট অন্য আরেকটি ছাত্রী পেলে তার শিক্ষাজীবন মসৃণ হতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে সেই মেয়েটি ব্যক্তিগতভাবে নিজে যেমন সুন্দর ক্যারিয়ার গঠন করতে পারতো, তেমনি দেশের কাজেও অবদান রাখতে পারতো। অপরদিকে আমরা দেখি, বেশিরভাগ বিবাহিত ছাত্রী কোনোমতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ যোগাড় করে হারিয়ে যাচ্ছে। তার নিজস্ব কোনো ক্যারিয়ারই থাকে না। তাহলে তাকে কেন শুধু শুধু একটি সিট দখল করে রাখার সুযোগ ঢাবি কর্তৃপক্ষ দেবে?
অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীদের হলে সিট না দেওয়ার ব্যাপারে ঢাবি কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ দিতেই হয়। বিয়ের পর জৈবিক কারণে একজন ছাত্রী অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেলে স্বাস্থ্যগত কারণেই তার বিশেষ যত্ন ও সুবিধার প্রয়োজন রয়েছে। হলে আবাসিক একজন ছাত্রীর জন্য এটি বলতে গেলে দুরাশা। হলের খাবারের মান নিয়ে নতুন করে সমালোচনা নাই বা করলাম। একজন অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীর যে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার দরকার, তা কি হল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করতে পারবে, নাকি তা সরবরাহ করা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব? নতুন যে শিশুটি পৃথিবীতে আসবে, তাকেও এভাবে একটা ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী তার একাডেমিক কার্যক্রমে কি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতে পারবে? বাস্তবতা বলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অনেকের ইয়ার লস হয়ে যায়। অথচ যে শিক্ষার্থী একাডেমিক সকল কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নেবে হলে সিট পাবার অধিকার তারই বেশি। তাহলে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রীকে হলে সিট দিয়ে আরেকজন সম্ভাবনাময় শিক্ষার্থীর সুযোগ কি সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলো না?
এরপর তো তাহলে অন্তঃসত্ত্বা ছাত্রী সন্তান প্রসবের পরে সন্তানসহ হলে থাকার আবদার করবে। নবজাতকের ক্ষেত্রে মাতৃদুগ্ধ পানের অধিকার তো হেলাফেলা করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হয়ে উঠবে কচিকাঁচার আসর! সে সময় হলের পরিবেশ কেমন হবে, একবার ভাবুন!
বাংলাদেশের পরিবারগুলোতে মেয়েদের শিক্ষা ও ক্যারিয়ারের চেয়ে বিয়েকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। এমন কি অনেক মেয়ে পড়ালেখা করেও বড়জোর ভালো একটি বিয়ে হওয়ার প্রত্যাশায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় বাল্যবিয়ের হারও দিন দিন বাড়ছে। এই মেয়েগুলো পরে নিজ মেধায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলেও, শুধুমাত্র হলে থাকতে না পারার জন্য হয়তো ঝরে যাবে। এ সমস্যাগুলো থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উচিত হবে, ‘ছাত্রীর সকল একাডেমিক কার্যক্রমে কোনো ধরনের বাধা প্রদান করা হবে না’, এই মর্মে বিবাহিত ছাত্রীদের স্বামী ও অভিভাবকের কাছ থেকে মুচলেকা গ্রহণ করা। এবং এরপর তাদের হলে সিট বরাদ্দ করা হবে। তাহলে মেধাবী ছাত্রীদের স্বামী ও পরিবারও সচেতন হবে, মেয়েদের পড়ালেখা ও ক্যারিয়ার গঠনেও সহযোগিতা করবে।
লেখক : শিক্ষক ও লেখক।